কালের কন্ঠের প্রতিবেদনে কাপাসিয়ার নির্বাচনী হাওয়া!

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত গাজীপুর-৪ আসন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদের এলাকা এটি। ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৮৬ সালেও জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট। এ ছাড়া ২০১২ সালে একটি উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে নিরাশ করেনি ভোটাররা। অনেকটা নিরাপদ আসন বলেই স্থানীয় বাঘা বাঘা নেতার চোখ এখানে। এক-দুজন নয়, পাঁচজন নেতা প্রার্থী হতে চান এ আসন থেকে। তবে আওয়ামী লীগের বড় ভয় ‘বিভক্তি আর বিরোধ’।

আওয়ামী লীগের এই ‘বিভক্তি আর বিরোধ’ থেকেই সুবিধা নিতে চায় বিএনপি। কারণ বরাবরই জয়-পরাজয়ে ভোটের ব্যবধান হয় কম। এখনো দলটির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীই সরব রয়েছেন। তবে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর আরো দুই-একজন ধানের শীষের টিকিট চাইতে পারেন।

আওয়ামী লীগ : এ আসনে বর্তমানে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি। তিনি ‘বঙ্গতাজ’ তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। এর আগে এখানে সংসদ সদস্য ছিলেন তাঁরই ছোট ভাই তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালের ৩১ মে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল সংসদ সদস্যপদ থেকেও পদত্যাগ করেন সোহেল তাজ। এরপর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে সিমিন হোসেন রিমি নির্বাচিত হন। ‘বঙ্গতাজ’ পরিবারের সদস্যদের প্রতি ভোটারদের ‘দরদ’ রয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।

কিন্তু দলের নেতাকর্মীরা বলছে, প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই রিমি দলের পুরনো, পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে ফেলেন। তাঁর আস্থাভাজন হয়ে ওঠে দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা। ওই অংশের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ দলবদল করে আসা। পরে ওই নেতারা নানা পর্যায়ে নেতৃত্ব পেয়ে তাদের পছন্দসই লোক দিয়ে দল সাজিয়েছে। এতে স্রেফ পুরনো, পরীক্ষিত ও ত্যাগীরাই নয়, দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে দলের অনেক ‘নক্ষত্র মুখ’কেও।

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দল নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ। কিন্তু নির্বিকার সিমিন হোসেন রিমি। ফলে নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ তাঁর ওপরও।

কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি দলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেন না।’ ফলে দলের ভেতর বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘এখন দলের বিরোধ যে অবস্থায় আছে, তাতে দল থেকে আবারও সিমিন হোসেন রিমিকে মনোনয়ন দেওয়া হলে জয়লাভ করা অসম্ভব হবে।’

নেতাকর্মীরা জানায়, বিগত ২০১৩ সালের ২৬ জানুয়ারি উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে সভাপতি নির্বাচিত হন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি এর আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। সভাপতি পদে পরাজিত প্রার্থী গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমানত হোসেন খান দাবি করেন, ওই সম্মেলনে সিমিন হোসেন রিমি প্রভাব বিস্তার করায় তাঁকে পরাজিত হতে হয়। এরপরই মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে শুরু হয় ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। এর প্রথম ধাপে উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় তাঁদের। পরে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে মতান্তরের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান আরিফসহ ১৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়। একইভাবে আনিছুর রহমান আরিফও বহিষ্কার করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে।

আনিছুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শহীদুল্লাহকে না জানিয়ে দলীয় কোনো কর্মসূচি পালন করলেও হামলা হয়।’ তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে কর্মসূচি পালনকালে তিনিসহ ১৫ জনকে পুলিশ আটক করে। পরে সাজানো মামলায় দলের ৬৭ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘সবই সাজানো অভিযোগ। দলের ভেতর কোনো সমস্যা নেই। কিছু নেতাকর্মী রয়েছে যারা আমাদের সীমার বাইরে চলে গেছে, তাদের ডাকলেও আসবে না। এ ছাড়া গ্রাম পর্যায় থেকে দলটিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চলছে।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের এমন বিরোধের মধ্যেই একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের উপদেষ্টা ও মরিয়ম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলম আহমেদ, গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমানত হোসেন খান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল আলম খান বেনু ও আনিছুর রহমান আরিফ মাঠে কাজ করছেন। তাঁরা সবাই মনোনয়নপ্রত্যাশী।

সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘কাপাসিয়ার মানুষের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। তারা কষ্ট পেলে আমি কষ্ট পাই, তারা সুখী হলে আমি সুখী হই। জনগণ খুব সহজেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। উপজেলাজুড়ে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। শুধু তাই নয়, মানুষের মানবিকতা ও সৃজনশীলতার জন্যও কাজ করছি। শিশু ও প্রসূতিসহ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্যও আমার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।’ দলের ভেতর বিরোধ প্রসঙ্গে রিমি আরো বলেন, ‘কাপাসিয়া আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি নেই। যারা জনগণের সঙ্গে মিশতে পারে না, তারাই দূরে সরে থাকে। এটা নির্বাচনে কোনো প্রভাবই ফেলবে না।’

আলম আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমি রাজনীতিতে সক্রিয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি ভালো মনে করেন, আর আমাকে সুযোগ দেন, তাহলে আমি নির্বাচন করব। কারণ আমি সব সময়ই কাপাসিয়ার সাধারণ মানুষের সঙ্গেই রয়েছি। সাধারণ মানুষের একজন ভালো কামলা (খেদমতগার অর্থে) হিসেবে তাদের পাশেই থাকব।’

আলম আহমেদ হলেন তাজউদ্দীন আহমদের ভাগিনা। দলের ভেতর প্রচার রয়েছে যে সিমিন হোসেন রিমির ছোট বোন মাহজাবিন আহমেদ মিমির সমর্থন রয়েছে আলম আহমেদের প্রতি। এ প্রসঙ্গে আলম আহমেদ আরো বলেন, ‘কাপাসিয়াবাসীর জন্য মিমির দরদও অপরিমেয়। মিমি মনে করেন, জনগণের জন্য আমি ভালো কাজ করতে পারব।’ তবে এ বিষয়ে মাহজাবিন আহমেদ মিমির বক্তব্য জানা যায়নি। এদিকে কাপাসিয়ায় কৃষক লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আলম আহমেদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী তাঁকে সমর্থন দিয়ে মাঠে সরব রয়েছে।

আমানত হোসেন খান বলেন, ‘বঙ্গতাজ’ তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তানজিম আহমদ সোহেল তাজকে দেওয়া হোক, সিমিন হোসেন রিমিকে নয়। কারণ বরাবরই এখানে বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে আমাদের প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। ঘরের কোন্দল রেখে তাঁকে (রিমি) মনোনয়ন দেওয়া হলে এ আসনটি হাতছাড়া হতে পারে।’

তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাঁর সঙ্গে রয়েছেন দাবি করে আমানত হোসেন আরো বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে জরিপ করা হলে আমিই মনোনয়ন পাব।’

মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল আলম খান বেনুও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি বলেন, ‘আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে আমি নির্বাচন করব।’ আনিছুর রহমান আরিফ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলের তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এর আগে উপনির্বাচনেও আমি মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলাম। এবারও মনোনয়ন চাইব।’

বিএনপি : ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) সালে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। পরবর্তী সব কয়টি নির্বাচনে হারলেও ভোট ব্যবধান বেশি ছিল না। আওয়ামী লীগ ছিল ঐক্যবদ্ধ, এখন ঘরে কোন্দল। আর বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থেকে তা কাজে লাগাতে চায়। এখন পর্যন্ত বিএনপি থেকে শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে সরব রয়েছেন। তিনি বিএনপির প্রয়াত নেতা আ স ম হান্নান শাহর ছেলে।

২০১৬ সালে হান্নান শাহর মৃত্যুর পর নেতাকর্মীদের মধ্যে তাঁর জন্য ‘সহানুভূতির’ একটা জায়গা তৈরি হয়। তারা (নেতাকর্মী) চায় শাহ্ রিয়াজুল হান্নানকেই দলের মনোনয়ন দেওয়া হোক।

এদিকে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দিন আহমেদও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে দাবি করেছেন। কিন্তু উপজেলা বিএনপির সভাপতি খলিলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সেলিম বলেন, ২০০৫ সালে জামাল উদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলের প্রাথমিক সদস্যপদও তাঁর নেই। জামাল উদ্দিনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে জামাল উদ্দিন দাবি করেন, ‘২০০৫ সালে আমি বহিষ্কার হলেও ওই বছরের জুন মাসে তা প্রত্যাহার করা হয়।’

উপজেলা বিএনপির সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, ‘উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বিএনপির কোনো বিভক্তি নেই। আমরা সব সময়ই এখানে ঐক্যবদ্ধ। আমরা শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজের জন্যই মনোনয়ন চাইব। তাঁর পক্ষেই সবাই কাজ করছে।’ তবে তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর কেউ কেউ মনোনয়ন চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দল যাঁকেই মনোনয়ন দেবে আমরা তাঁর জন্যই কাজ করব।’ শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছি। দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’

সরকারের সমালোচনা করে রিয়াজ আরো বলেন, ‘অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করছি। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের অনেক সাড়া পেয়েছি। সাধারণ মানুষ চায় আমি যেন সব সময় তাদের পাশে থাকি।’

সিপিবি : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মানবেন্দ্র দেব দল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠ কাজ করছি। দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’

প্রতিবেদন লিঙ্ক

No comments

Theme images by Storman. Powered by Blogger.